ঘুরে এলাম সুইজারল্যান্ডঃ
ঘুরে এলাম সুইজারল্যান্ডঃ
১৬ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, আমার এই সময়টা নতুন একটা দেশ দেখার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। আর সেই দেশটির নাম সুইজারল্যান্ড। এই সময়ের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের দুইটি শহর জেনেভো ও বার্ন এবং ফ্রান্সের একটি পর্বত সালেভ ভ্রমনের সুযোগ হয়েছে।
জেনেভাঃ
প্রথমেই বাংলাদেশ থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে ইস্তানবুল হয়ে পৌছাই জেনেভায়। এই সময়টায় সেখানে সামার হওয়ার কথা নয় তবুও সামার চলছিল। স্থানীয়দের ভাষায় এক্সটেনডেড সামার। স্থানীয়রা সবাই ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে এবং তারা শহরটাকে জেনেভা নয় জেনিভ নামে ডাকে। ইংরেজী সবাই জানেনা তাই কারও সাথে ইংরেজীতে কথা বলতে হলে প্রথমে জিজ্ঞাসা করতে হয় ইংলিশ পারে কি না! পুরো জেনেভা শহরটা জেনেভা লেকের কোল ঘেষে বিস্তৃত। এই লেকের পাড়েই সকাল-বিকাল শহরের লোকদের আনাগোন-বিনোদন, অথচ লেকের পানি এতই স্বচ্ছ ও পরিস্কার যে একটা চকলেটের কাগজ পর্যন্ত দেখা যায় না। লেকের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ফোয়ারা নির্মান করা আছে যা হতে পানি প্রায় ৩০০ ফুট পর্যন্ত উচুঁতে ওঠে। অনেক দূর থেকে ফোয়ারাটি দেখা যায়। এটাকে জেনেভার একটা পরিচিতিও বলা যেতে পারে।
বার্ন (সুইস ফেডারেশনের রাজধানী)-
জেনেভা থেকে হাই স্পীড ট্রেনে গিয়েছিলাম সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে ঘুরতে। দুই ধরণের ট্রেন আছে সাধারন আর দোতলা। আমার ভাগ্যে দুটোই দেখার সুযোগ হয়েছে। যাওয়ার সময় দোতলা আর ফেরার সময় একতলা সাধারন। জেনেভা থেকে ট্রেনে বার্নে যেতে সময় লাগে ১ ঘন্টা ৫৬ মিনিট। বার্নে জেনোভার মত লেক না থাকলেও আছে একটি নদী। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির পানি এতই স্বচ্ছ ও পরিস্কার যে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায় সব জায়গাতেই। আর এখানে আছে ওল্ড সিটি যা পুরোটাই ইউনেস্কো ওয়াল্ড হেরিটেজ। ওল্ড সিটির সবচেয়ে উঁচু জায়গাটার নাম রোজেন গার্ডেন, যেখান থেকে পুরো বার্ন শহরটাকে দেখা যায়।
সালেভ (ফ্রান্স)-
সালেভ অসাধারণ সুন্দর একটা জায়গা। প্রায় ৪০০০ ফুট উঁচু একটা পাহাড় যেখানে যেতে হয় ক্যাবল কারের মাধ্যমে। জেনেভা শহর থেকে ৪০ মিনিট বাস জার্নি তারপর পায়ে হেঁটে ফ্রান্স বর্ডার পার হয়ে সালেভ। যারা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাবেন তাদের বলবো অবশ্য সালেভের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।
শহর ভ্রমনের মাধ্যমঃ
সাইকেল আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের রাজত্ব এখনে। বাস, ট্রাম আর লেকের হলুদ বোট সবই সরকার পরিচালিত। প্রাইভেট গাড়ী খুব একটা বেশি নয়। আর থাকলেও যারা প্রাইভেট গাড়ী চালায় তারাই বেশি বিড়ম্বনার স্বীকার বলে মনে হল। কারণ প্রাইভেট গাড়ী চালানোর লেন খুবই সংকুচিত এবং পার্কিং খুবই ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। সময় সাপেক্ষ এইজন্য বলছি যে, যেখানে আমার কাজ সেখানে হয়ত পার্কিং এর জায়গা ফাঁকা নেই সেক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক দূরে যেখানে পার্কিং এর জায়গা ফাঁকা আছে সেখানে গাড়ী রেখে আসতে হয়। কখনও কখনও তা হতে পারে ২-৩ কিলোমিটার দূরে! আর মটরসাইকেল আছে কিছু। তবে পায়ে হেঁটে যারা চলাফেরা করে তাদের অগ্রাধীকার এখানে। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হলে দূর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের টিকিট বিভিন্ন মেয়াদে কেনা যায় যেমনঃ ১ ঘন্টার জন্য নিলে ৩ সুইস ফ্রাঙ্ক, ৫ ঘন্টার জন্য নিলে ৫ সুইস ফ্রাঙ্ক, সারাদিনের জন্য কিনতে চাইলে ১০ সুইস ফ্রাঙ্ক, আর এক মাসের জন্য হলে ৩৯ সুইস ফ্রাঙ্ক। আবার দুইজনের জন্য একসাথে কিনলে কিছুটা ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় মানে দাম কম আর কি। এই একটি টিকিট দিয়েই শহরের ভেতরে যে কোন বাস, ট্রাম বা লেকের হলুদ রঙের বোর্টে চড়া যাবে যতক্ষণ ভ্যালিডিটি আছে।
খাওয়া-দাওয়াঃ
সুইসরা সাধারনত ফাস্ট ফুড আর পনির বেশি পছন্দ করে। সুইস ব্রেড খেতে হলে দাঁত অনেক মজবুত হতে হবে আর চোয়ালে অনেক শক্তি থাকা চাই। তবে কোসান নামে একটা ব্রেড পাওয়া যায়, দেখতে অনেকটা শামুকের মত; এইটা অনেক নরম ও সুস্বাদু। এছাড়া প্রচুর ফল পাওয়া যায় যেগুলো অনেক সস্তা (যেমনঃ আঙ্গুর, আপেল, কমলা লেবু)। মাছ, মাংস, শাক-সবজি সবই প্রায় পাওয়া যায়। টার্কিস দোকান গুলো সাধারণত মাংস বিক্রি করে (হালাল)। গুরু, মুরগী, ভেড়ার মাংস পাওয়া যায়। আর কিছু শ্রীলংকান দোকান আছে এরা মাছ বিক্রি করে। কিছু ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশি খাবার হোটেল আছে যেখানে হালাল খাবার পাওয়া যায় তবে সংখ্যায় খুবই কম। জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনের নিচে একটা বাংলাদেশী দোকান আছে, আর আশেপাশে দুই একটা বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান খাবারের হোটেল আছে। জেনে রাখা ভালো যে এক বোতল পানির দাম এক বোতল কোক বা এক বোতল জুসের চেয়ে বেশি। কারণ সেখানে যে সকল কলে পানি আসে তার সবগুলোই নিরাপদ খাওয়ার পানি। তাই পানি কিনে খাওয়াটা একটা বিলাসিতার অন্তর্ভূক্ত।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ
জেনেভা এয়ারপোর্টে নেমেই ব্যাগেজ ক্লেইম বেল্টের পরপরই একটা অটো মেশিন আছে যেখান থেকে আপনি জেনেভা শহরে চলাচলের জন্য ৮০ (আশি) মিনিট মেয়াদের একটি ফ্রি টিকিট নিতে পারবেন। এই টিকিট টি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় যাতে আপনি সহজেই আপনার প্রথম গন্তব্য পর্যন্ত পৌছাতে পারেন। যে হোটেলে আপনি থাকবেন (যদি হোটেলে থাকেন) সেই হোটেল হতে আপনাকে ফ্রি ট্রাভেল কার্ড ইস্যু করে দেবে আর সেই কার্ড দিয়ে আপনি শহরের যে কোন পাবিলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে পারবেন একদম ফ্রি তে।
খরচঃ (১ সুইস ফ্রাঙ্ক = ৮৭ টাকা প্রায়)
টার্কিশ এয়ারলাইন্সে ঢাকা-ইস্তানবুল-জেনেভা এবং জেনেভা-ইস্তানবুল-ঢাকা রাউন্ড ট্রিপ এর খরচ পড়বে ৮০ হাজার টাকা প্রায়।
হোটেল ভাড়া ১৫০ থেকে ১৮০ সুইস ফ্রাঙ্ক ।
খাবার খরচঃ প্রতিদিন গড়ে ৫০ সুইস ফ্রাঙ্ক (দুপুর + রাত) সকালের নাস্তা সাধারনত হোটেল ভাড়ার সাথে কমপ্লিমেন্টারী থাকে।
যাতায়াত খরচঃ একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্টের টিকিট কিনলে শহরের ভেতর চালিত সকল ট্রাম, বাস এবং লেকের হলুদ রঙের বোর্টে চড়া যায়। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের টিকিট বিভিন্ন মেয়াদে কেনা যায় যেমনঃ ১ ঘন্টার জন্য নিলে ৩ সুইস ফ্রাঙ্ক, ৫ ঘন্টার জন্য নিলে ৫ সুইস ফ্রাঙ্ক, সারাদিনের জন্য কিনতে চাইলে ১০ সুইস ফ্রাঙ্ক, আর এক মাসের জন্য হলে ৩৯ সুইস ফ্রাঙ্ক।
জেনেভা থেকে বার্ন যাওয়া-আসা (রিটার্ন টিকিট) = ১০২ সুইস ফ্রাঙ্ক।
সালেভ (ফ্রান্স) এর কেবল কারের উঠা-নামার টিকিট = ১১.৯০ সুইস ফ্রাঙ্ক।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশী টাকায় খরচ প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার কাছাকাছি।
সচেতনতাঃ
জেনেভা, বার্ন এবং সালেভের রাস্তা, নদী, লেক, পাহাড়ে প্রতিদিন অসংখ্য লোক চলাচল/যাতায়াত করে। কিন্তু এসবের কোথায় আমার চোখে ময়লা, আবর্জনা, খাবারের প্যাকেট, জুসের/কোল্ড ড্রিংসের বোতল এমনকি থুথু পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য নিদ্দিষ্ট স্থানে বিন আছে সবাই সেটার সর্বোত্তম ব্যবহার করেন। আমার মনে পড়ে বার্নে নদীর পাড় ধরে হাঁটার সময় আমি একটা কলা খেয়ে কলার খোসা ফেলার জন্য তা হাতে নিয়ে প্রায় ১০ মিনিট ঘোড়াঘুরি করেছি। তারপরও যখন বিন নজরে পড়ছিল না, তখন কাগজে মুড়ে নিজের ব্যাক-প্যাকে ভরে রেখেছিলাম যাতে বিন দেখলে সেখানে ফেলতে পারি। অথচ আমার পাশেই নদী। ইচ্ছে করলেই আমি নদীতে ফেলতে পারতাম। কিন্তু নদীর পানি এতই পরিস্কার ও স্বচ্ছ যে মন চাইছিলো না। আর যেহেতু কেউ এমন কাজ সেখানে করেন না তাই নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল নদীতে ফেলতে। আসুন আমরা সবাই সচেতন হই। ময়লা-আবর্জনা যথা স্থানে ফেলি। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের নিজেদের সচেতনতাই যথেষ্ট। যে যেখানেই ভ্রমনে যাই না কেন। সবসময় চেষ্টা করি যেন আমার দ্বারা পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয়।